মেডিকেল ট্যুরিজম সংস্থা আর ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট এডভাইসরি হাউসের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।
ক্যান্সার এমন একটি বহুমুখী রোগ যার ব্যাপকতা , বিস্তার আর চরিত্র প্রত্যেক রুগী বিশেষে আলাদা আলাদা হয়। তাই তার ট্রিটমেন্টেও সেই প্রভাব পরে এবং সেই জন্যই ক্যান্সার এর চিকিৎসা রুগী ভিত্তিক ও কাস্টোমাইস্ড করা হয়। একটু বুঝিয়ে বলতে গেলে একটা উদাহরণ দিতে হয়।
আমি দুটি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি।
কেস ১ : –
আমাদের কাছে একটি রুগী আসে কোলন ক্যান্সার নিয়ে। নাম আব্দুল খালেক। নাম টা বলেই দিচ্ছি কারণ এই নামের অনেক রুগী আছে সুতরাং তাকে আলাদা করে চিহ্নিত কেউ করতে পারবে না। নিবাস বাংলাদেশ। এই রুগী কে বিশেষ ভাবেই আমার মনে আছে কারণ এর পিছনে একটি দুঃখজনক চিকিৎসা বিভ্রাটের ইতিহাস আছ। আগে ইতিহাস টুকু বলে নেই।
আব্দুল খালেক মহাশয়ের প্রথম ক্যান্সার সন্দেহ করা হয় দীর্ঘ ৬ মাস পায়খানায় রক্ত আসার পর আর হজমের সমস্যার পরে, কোলোনোস্কপি করে। সেটা ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে। তার পর বায়োপসি রিপোর্টে ম্যালিগন্যান্ট কার্সিনোমা অর্থাৎ ক্যান্সার আসে। সৌভাগ্যবশত তার কাছে পাসপোর্ট ছিল। তিনি দ্রুত ভিসা করতে যান ঢাকা শহরেই কোনো এক ভিসা এজেন্ট এবং মেডিকেল টুরিসম সংস্থার কাছে এবং সেখানেই তিনি সেই ভিসা এজেন্টের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছান ইন্ডিয়ায় দিল্লি তে একটি ভালো হাসপাতালে।
হাসপাতাল টি ভালো হাসপাতাল হলেও ক্যান্সার হাসপাতাল ছিল না। রুগীর ক্যান্সার ছিল রেকটাম বা পায়খানা দ্বারের মাত্র তিন সেন্টিমিটার উপরে। সাধারণত রেক্টামের এতো কাছে ক্যান্সার পৌঁছে গেলে রেকটাম টা আর কার্যকরী রাখা যায় না এবং বিকল্প পায়খানার দ্বার হিসাবে পার্মানেন্ট কলোসটমি ব্যাগ বসিয়ে দেয়া হয় পেটের সাইডে । আব্দুল খালেক ভাই এর ক্ষেত্রে কিন্তু সেই ব্যাগ বসানো হয় নি। রেকটাম টা কে অবিকৃত রেখেই অপারেশন করে কেমো দিতে বলা হয়। তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং কেমো শুরু করেন। ৬ টি কেমো শেষ হয় 2023 এর অগাস্ট মাসে , নভেম্বর মাসের আবার রক্তপাত , ব্যাথা , এবং আগের সব উপসর্গই ফিরে আসে। সেই সময় তিনি রিপোর্ট পাঠান আমাদের কাছে। ওনার রিপোর্ট এনালাইজ করে আমরা বুঝতে পারি যে ভুল টা কোথায় হয়েছে এবং এটাও অনুমান করি যে এই অবস্থায় ক্যান্সার কোথায় কোথায় ছড়াতে পারে। সেই গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা ওনাকে রেকমেন্ড করি বেঙ্গালুরু তে একটি নির্দিষ্ট ক্যান্সার হাসপাতালে যেখানে গ্যাস্ট্রো অঙ্কসার্জেনের সাথে সাথে একজন বিশ্ব বিখ্যাত মেডিকেল অনকোলজিস্ট ও ছিলেন। কারণ আমরা বুঝতেই পারছিলাম যে সেই মুহূর্তে ওনার ক্যান্সার অনেক হাইয়ার স্টেজ এ আছে এবং সার্জারির সাথে সাথে স্পেসিফিক কেমো লাগবেই। আমরা ওনার রিপোর্ট সেই হাসপাতালে পাঠিয়ে আগে একটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সম্ভাব্য ট্রিটমেন্ট প্রটোকল তৈরী করি এবং তারপর রুগীর পরিজনদের একসাথে নিয়ে একটা ভিডিও কোলে তাদের কে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে বলি।
এরপর উনি আমাদের এডভাইস মতো সেই হাসপাতালে আসার পর PET CT স্ক্যান করে দেখা যায় ক্যান্সার এর ঘা রেকটাম ছুঁয়ে ফেলেছে এবং কোলনের উপরের দিকে ৮ সেন্টি মিটার এগিয়েছে ! তার মানে আগের বারের অপারেশনে রেকটাম টা কে বাঁচানোর জন্য পুরো ক্যান্সার আক্রান্ত অংশ টি অপসারণ করা হয় নি এবং তার পরে কেমো তে ও হয়তো সেইভাবে কাজ করে নি তাই এতো দ্রুত আবার সেই জায়গা থেকে ক্যান্সার ছড়িয়ে উপরের দিকে উঠেছে। এবার ওনার কোলনের অনেকটা অংশ সার্জারি করে বাদ দেয়ার পর ওনাকে হিস্টোপ্যাথোলজি রিপোর্টে প্রাপ্ত ক্যান্সার কোষ এর চরিত্র বুঝে কেমো আর তার সাথে রেডিয়েশন একসাথে দেয়া হয়। এখন রুগী সদ্য সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন এবং ওনাকে প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর হাসপাতালে এসে ফলো আপ চেক আপ করার কথা বলা হয়েছে। আশা করি এবার উনি ভালো থাকবেন যদিও ক্যান্সার যে ফিরে আসবেই না , সেটা কেউ বলতে পারে না।
কেস ২ : –
সারিনা আখতার , নিবাস বাংলাদেশ। দেশে রিপোর্টে হাইপারপ্লাসিয়া সাসপেক্ট করে ওনার , কিন্তু প্রশ্ন চিহ্ন দিয়ে কার্সিনোমা ও উল্লেখ করা হয়। । ওনার এক বছর আগে করা রিপোর্টে কেবলমাত্র হাইপারপ্লাসিয়া ডায়াগনসিস ছিলো। যদিও হাইপারপ্লাসিয়া মানে ক্যান্সার নয় তবু যেহেতু রিসেন্ট রিপোর্টে ক্যান্সার এর একটা সম্ভাবনার উল্লেখ ছিলো তাই হয়তো উপদেশ মতো বায়োপসি ওখানে না করিয়ে উনি নিশ্চিত হবার জন্যে ইন্ডিয়া তে আসতে চান এবং প্রথমেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন একটি সোশ্যাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে।
আমরা ওনাকে এডভাইস করি চেন্নাই তে একটি ক্যান্সার বিশেষত হাসপাতালের একজন বিশেষ ডাক্তার কে দেখানোর জন্য। উনি ইন্ডিয়া তে আসার পর সেই হাসপাতালে যাবার পর প্রথমেই ওনার রিপিট কোলোনোস্কোপি করানো হয় এবং কোলনের সেই টিউমারগুলো থেকে টিস্যু নিয়ে বায়োপসি করানো হয়। রিপোর্ট আসে এডেনো কার্সিনোমা। এরপরে PET CT করানো হয় ও দেখা যায় কোলনের ডিসেন্ডিং পার্ট এর প্রায় ৪ সেন্টি মিটার জুড়ে ক্যান্সার এর আক্রমণ রয়েছে। এবং যায়গা টা রেকটাম এর অনেক উপরে। এরপরে গ্যাস্ট্রো অঙ্কসার্জেনের হাতে ওনার সুনিপুন অপারেশন হয় এবং পরবর্তী কালে ৩ মাসের জন্য টেম্পোরারি কলোসটমি ব্যাগ বসানো হয় এবং তারপরে খুলে ফেলা হয়। ফলো আপ কেমো দেবার পর এখনো পর্যন্ত রুগীর প্রায় ১ বছর পার হয়ে গেছে এবং রুগী ভালো আছেন।
উপসংহার :
এই দুটি ঘটনা কিন্তু একই রোগের কিন্তু যার ট্রিটমেন্ট প্রটোকল আর আউট কাম দুটোই আলাদা। সেই জন্যই বলা হয় ক্যান্সার এর চিকিৎসা ব্যক্তি হিসাবে ডিসাইন বা কাস্টোমাইজ করা হয়। কোনো এক ক্যান্সার এ কেউ কোনো হাসপাতালে ভালো হয়েছে বলেই যে সেই একই ক্যান্সার এ সেই হাসপাতালে অপর একটি রুগী ভালো ফল পাবে, সেটা বলা যায় না। আর এখানেই লাগে অভিজ্ঞ পরামর্শ যেটা কখনোই একজন ভিসা এজেন্ট এর পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। আর একজন মেডিকেল টুরিসম অপারেটর আপনাকে ভালো হাসপাতালের ঠিকানা বলতেই পারে কিন্তু আপনার রোগ এবং তার চরিত্র ও বিস্তার বুঝে আপনাকে আপনার ফিনান্সিয়াল লিমিটেশনের মধ্যে এবং কোয়ালিটি তে কম্প্রোমাইজ না করে বেস্ট হাসপাতাল বা ডাক্তার এডভাইস করতে লাগে সেই সংস্থা বা ব্যক্তির নিজস্ব জ্ঞান ক্যান্সার সম্বন্ধে এবং তার বহু বছরের ক্যান্সার নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা যেটা একটি মেডিকেল টুরিজম অপারেটরের কাছে আশা করা টা অত্যধিক বেশি চাহিদা হয়ে যাবে।
এখানেই ইন্ডিয়ান ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট সমস্ত মেডিকেল ট্যুরিজম এর থেকে আলাদা কারণ আমরা একটি এডভাইসরি হাউস এবং আমরা প্রাথমিক বা “কোর” ভাবে রুগী কে এডভাইস করি তার বেস্ট অপশন সম্বন্ধ। মেডিকেল ট্যুরিজম এর কাজ আমরা করি না। আমরা রুগীর টিকেট কেটে দেবার সার্ভিস দেই না , আমরা রুগীর হোটেল বা লজিস্টিক এর দায়িত্ব নিজেরা নেই না। আমরা হাসপাতাল কে দিয়ে রুগীর পিক-আপ আর থাকার ব্যবস্থা করিয়ে দেই, আমরা নিজেরা করি না।
তাই আপনি বা আপনার পরিচিত জন ক্যান্সার আক্রান্ত হলে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করবেন যে কেনো যেখানে সেখানে না গিয়ে কেবলমাত্র “ইন্ডিয়ান ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট ” এর কাছেই আসবেন।
ইন্ডিয়ান ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট , ইন্ডিয়ার একমাত্র নির্ভরযোগ্য ক্যান্সার স্পেসিফিক ট্রিটমেন্ট এডভাইসরি হাউস – এটা ভুলবেন না।