আমি ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে প্রায়শঃই কিছু কমন প্রশ্ন দেখি।
যেমন, অমুক জায়গার বেস্ট হাসপাতাল কোনটা ?
ইন্ডিয়ার বেস্ট গাস্ট্রো ডক্টর কে বা কলকাতার বেস্ট গাষ্ট্র ডক্টর কে, এমন কি সি এম সি তে বেস্ট অমুকের ডক্টর কে বা টাটা এর বেস্ট কান্সার ডক্টর কে ! ইত্যাদি।
মনে মনে ভাবি যে ধন্য তুমি বাঙ্গালী !
আমরা চিকিৎসার ক্ষেত্রে নন মেডিক্যাল পাবলিক অপিনিয়ন নিচ্ছি। আর এই সব প্রশ্নের উত্তরে এক গাদা গুচ্ছের উত্তর আসে। এবং প্রতিটি উত্তর ই বিভিন্ন হাসপাতালের নাম বা ডক্টরের নাম উল্লেখ করে। যে যাকে দেখিয়ে উপকার পেয়েছেন বা হয়তো দেখানও নি, শুধু কারোর মুখে ডক্টর বা হাসপাতালের নাম শুনেছেন সেটাই বলে দিলেন মাতব্বরি করে। আর প্রশ্ন কর্তারা সেই উত্তর শুনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এর মধ্যে একটু চালাক রুগী কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী রা বেশ গল্পঃ করে ইনবক্স এ দিকে সুন্দর ভাবে একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে নেন।
আপনারা কখনো ভেবে দেখেছেন যে , আমাদের দৈনন্দিন নিত্য কর্মের বা পছন্দের মধ্যে মানুষ বা ব্যক্তি হিসাবে কতো টা পার্থক্য থাকে ? আপনি ১০ জন মানুষ কে জিজ্ঞেস করে দেখুন যে তাদের প্রিয় খাবার কি। দেখবেন কেউ বলবে বিরিয়ানি তো কেউ বলবে চাউমিন, আবার কেউ যদি বলে ইলিশ মাছ তো কেউ বলবে মাটন। এই তো অবস্থা।
দয়া করে স্বাস্থ্য বিষয়ক সিদ্ধান্ত এই ভাবে নেবেন না। আজকাল গুগল আছে, একটু সার্চ করুন, ফিডব্যাক দেখুন ( অবশ্য সবসময় ফিডব্যাক গুলো ও যে খুব অথেনটিক হয়, তা নয় ), মেডিক্যাল ফ্রাটার্নিতি দের ডিগ্রি দেখুন। আপনি উত্তর পেয়েই যাবেন।
উদাহরণ হিসাবে বলি, আপনি যদি গাস্ট্র ডক্টর দেখাতে চান, তাহলে চুজ করুন DM Gastro, আর যদি গ্যাস্ট্রো সার্জেন দেখাতে চান তাহলে চুজ করুন MS gastro বা MCh । এইগুলোই হায়েস্ট ডিগ্রী। যাদের এই ডিগ্রী আছে, সবার ই গুণগত দক্ষতা একই রকম হওয়া উচিত। কিন্তু যেটা পার্থক্য তৈরি করে সেটা হলো সেই ডক্টরের ক্লিনিক্যাল আই বা চিকিৎসার দক্ষতা। জানবেন যে কোনো ভালো প্রাইভেট হাসপাতাল এর পণ্য ই হলো ডক্টর। সুতরাং আপনি যদি একটি ভালো ব্র্যান্ড চুজ করেন, সেখানকার সব ডক্টর ই ১৯ আর ২০। এর জন্য মাইকে আনাউন্স করে ডক্টর খোঁজার কোনো মানে হয় না।
এবার আসি ক্যান্সার এর ক্ষেত্রে। এটা অনেকের কাছেই বেশ গন্ডগোল এর ব্যাপার।
বাংলাদেশের একটি কমন ট্রেন্ড হচ্ছে রুগী পেলেই আগে কেমো ধরিয়ে দেওয়া। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে। তার মধ্যে প্রধান কারণ হিসাবে দেখানো হয় যে টিউমার টি বড় হয়ে গেছে। কেমো দিয়ে ছোট করে অপারেশন করা হবে। ধরুন কারোর ইউটেরাস এ একটি বড়ো টিউমার হয়েছে। এবার রুগী গেলো বাংলাদেশে কোনো গাইনী ডক্টর এর কাছে। তিনি ক্যান্সার বুঝে আগেই রেফার করবেন একজন মেডিক্যাল অঙ্কলজিস্ট কে। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেখানে যথাযথ সার্জিকাল অঙ্কলোজিস্ট এর প্রচুর অভাব সেখানে ক্যান্সার এর ডক্টর হিসাবে মেডিক্যাল অনকোলজিস্ট কেই ধরা হয়। মেডিক্যাল অনকলোজিস্ট এর কাজ কি ? অপারেশন করা ?
নাহ। শুধু মাত্র কেমো বা টার্গেটেড থেরাপি দেওয়া। সুতরাং তিনি রুগী ছাড়বেন কেনো ? তিনি দিয়ে দেবেন 6 টি বা 12 টি কেমো। তারপরে রেফার করে দেবেন একজন সার্জেন বা ভাগ্য ভালো হলে অঙ্ক সার্জেন। তিনি সেই মুহূর্তে পরীক্ষা করে দেখবেন টিউমার টি ছোট সুতরাং সেই টিউমার টি অপারেশন করে দেবেন। সাধারণত ক্যান্সার সার্জারির আগে একটি PET CT করানো বাঞ্ছনীয় । এর মাধ্যমে শরীরের মধ্যে কোথায় কোথায় ক্যান্সার কতোটা ছড়িয়েছে সেটা বোঝা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ রুগীর ক্ষেত্রেই সেটি আমরা দেখি না। ওই রিপোর্ট ছাড়াই , টিউমার বোর্ড না বসিয়েই একক সিদ্ধান্তে অপারেশন করা হয়। তার ফলে যতটা ক্যান্সার আক্রান্ত অঞ্চল ছিলো, পুরোটা অপারেশন করে বের করা হয় না। ফলতঃ যেটা হয় বছর খানেক বা তার ও কম সময়ের মধ্যে ক্যান্সার এর ফিরে আসা।
আসুন একটু দেখে নেই আদর্শ ক্যান্সার চিকিৎসা পদ্ধতি টির রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত।
ক্যান্সার নিয়ে যখন কোনো রুগী কে কোনো ডক্টর ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করেন, তখন প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে তাকে আগে একজন মেডিক্যাল অনকলজিস্ট দেখে নিয়ে প্রয়োজনীয় টেস্ট গুলি করেন । এর মধ্যে থাকতে পারে, CT scan, MRI, USG , রক্তে টিউমার মার্কার টেস্ট এবং অবশ্যই PET CT scan । এই সমস্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিউমার বোর্ড তৈরি করা হয় যেখানে মেডিক্যাল অঙ্কলোজিষ্ট্, রেডিয়েশন অঙ্কলজিষ্ট্ এবং সার্জিকাল অঙ্কোলোজিস্ট থাকেন। সেখানে রীতিমত এভিডেন্স দিয়ে বৈজ্ঞানিক যুক্তি তর্কের ভিত্তি তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে কি পদ্ধতি তে ট্রিটমেন্ট এগোবে। পদ্ধতি গুলি নিম্নরূপ ……..
১. আগে সার্জারি, পরে লাগলে কেমো বা রেডিয়েশন ( সাধারণত স্টেজ 1/2 )
২. আগে রেডিয়েশন পরে সার্জারি ( স্টেজ 3/4 )
৩. আগে কেমো পরে সার্জারি ( স্টেজ 3/4 )
৪. শুধুই কেমো ( স্টেজ 4 )
এবার রুগীর স্বাস্থ্য, অন্যান্য মেডিক্যাল প্যারামিটার, ক্যান্সার এর স্টেজ আর বিস্তার, অর্থনৈতিক ক্ষমতা, সব বিচার করে তারপর কোন পদ্ধতি তে চিকিৎসা এগিয়ে চলবে সেটি স্থির করা হয়।
এবার আরো একটি ব্যাপার আছে। যদি সার্জারি লাগে তাহলে শুধু সার্জিকাল অনকোলজিস্ট এর সার্জারি করার দিন এখন আর নেই। এখন সুপার স্পেশালিটি সব জায়গায়। আমি একটু বোঝানোর চেষ্টা করছি।
গাইনী অনকোলজিস্ট – কেবল ইউটেরাস, ওভারি আর সারভিক্যাল ও ভ্যাজাইনাল ক্যান্সার এর সার্জারি করেন।
ব্রেস্ট প্রস্থেটিক অনকোলজিস্ট – শুধু মাত্র ব্রেস্ট ক্যান্সার , ব্রেস্ট পুনর্গঠন, বা ব্রেস্ট কনসার্ভ করার সার্জারি করেন।
থোরাসিক অনকোলজিস্ট- বক্ষ বিভাগের মধ্যে যেকোনো ক্যান্সারের সার্জারি করেন যেমন লাঞ্চ ক্যান্সার বা বুকের ভিতর কোনো টিউমার এবং ক্যানসার ইত্যাদি।
গ্যাস্ট্রো অনকোলজিস্ট – আমাদের পরিপাকতন্ত্রের মধ্যে যেকোনো ধরনের ক্যান্সার সার্জারি এনারা করেন।
ইউরো অনকোলজিস্ট – কিডনি এবং মূত্রনালী এবং প্রোস্টেট সংক্রান্ত যেকোন ক্যান্সারের অপারেশন এনারা করেন।
হেপাটো অনকোলজিস্ট – লিভার ও প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সারের সার্জারি ওনারা করেন
ওরাল অনকোলজিস্ট – মুখগহবরের ভিতরে যে ক্যান্সার সার্জারি এনারা করেন।
হেড এন্ড নেক অনকোলজিস্ট – মাথা ও ঘাড় এর ক্যান্সার এর সার্জারি এনারা করেন।
ব্রেন টিউমার বা ব্রেইন ক্যান্সার – নিউরো ক্যান্সার সার্জেন রা এর অপারেশন করেন।
এই ভাবে সার্জিকাল অনকোলজিস্ট চুজ করা হয়।
সুতরাং চিকিৎসা করানোর আগে নিজেরা আগে জানুন যে কিভাবে বা কাদের দিয়ে চিকিৎসা করানো উচিত। ক্যান্সার এর চিকিৎসা কিন্তু একজন বিশেষ নাম করা ডক্টরের কাজ নয় বরং একটা বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান একটা গ্রুপ অফ ডক্টর এর মাধ্যমে এর সফল চিকিৎসা করা হয়।
তাই নিজে জানুন ও শেয়ার করে অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।
ধন্যবাদ।