কথাটা শুনতে খুব অদ্ভুত লাগছে হয়তো কিন্তু এটাই বাস্তব। এটাই হতে চলেছে এবং এর সাথে সাথে অশিক্ষা ও অজ্ঞানতার মাশুল গুনতে চলেছে বহু রুগী ও তাদের পরিজন। আসুন বোঝার চেষ্টা করি ব্যাপার টা আদপেই কি !
ভারতবর্ষে বর্তমান ক্যান্সার রুগীর সংখ্যা কম করে হলেও প্রায় ৩৫ লাখের আশে পাশে। এর সাথে প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে প্রায় ১২/১৩ লাখ নতুন আক্রান্ত রুগী। আর প্রতি বছর মারা যাচ্ছেন প্রায় ৮ লাখ মানুষ ( Ref : cancer statistics : icmr / NICPR data ) এটা শুধু ভারতবর্ষের ফিগার বললাম। ভারতবর্ষের ক্যান্সার মানচিত্রে একটা বড়ো ফ্যাক্টর হলো এদেশের ক্যান্সার পরিষেবার উপর নির্ভরতা কেবলমাত্র দেশীয় নয়, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান ও ভারতের ই ক্যান্সার পরিষেবা ব্যবহার করছে বিগত কয়েক দশক ধরে। এদের মধ্যে সব থেকে বেশি লোড আসে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশে ক্যান্সার রুগীর সংখ্যা নয় নয় করেও প্রায় ১৮ লাখের কাছাকাছি ( সরকারি হিসাবে ) এবং প্রতি বছর নতুন ভাবে আক্রান্ত হচ্ছে আরো প্রায় লাখ তিনেক মানুষ। এই সংখ্যার একটা বড়ো অংশই আসেন ভারতে কিছু মুষ্টিমেয় হাসপাতালে।
আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি ভাবে ক্যান্সার সেন্টার আছে ৬২ টি। এর মধ্যে সিংহভাগ ই সরকারি পরিকাঠামো। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে বা নাম মাত্র মূল্যে ক্যান্সার পরিষেবা পাবার কথা। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা যায় ক্যান্সার সংক্রান্ত হেলথ কেয়ার কস্ট এর মাত্র ২০ শতাংশ হয় সরকারি পরিকাঠামো এ এবং ৮০ ভাগ খরচ মানুষ করে বেসরকারি পরিকাঠামো তে। এর মানে একটাই যে হয় সরকারি পরিকাঠামো তে মানুষ সেই সর্বোচ্চ গুণমান এর পরিষেবা পায় না অথবা সেই পরিষেবা দেবার যথাযথ ব্যবস্থা ই নেই। সেই জন্যই বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতে এতো রুগী যায়। ভারতে সু গুনমানের প্রায় ১০/১১ টি ক্যান্সার হাসপাতাল থাকলেও ( বেসরকারি ও ট্রাস্টি মিলিত ভাবে ) ছোটখাটো সেন্টার রয়েছে ডজনখানেক, এবং এগুলি মূলত বিভিন্ন মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতালের একটি ডিপার্টমেন্ট হিসাবেই টিকে আছে। এই ধরনের হাসপাতালে সাধারণত ক্যান্সার এর আধুনিক চিকিৎসার উপর যতটা না ফোকাস, তার থেকে বেশি হলো কোনো রুগী ছাড়া যাবে না, তাই ক্যান্সার এলেও ভর্তি করতে হবে কারণ যাতে রেভিনিউ হাত থেকে বেরিয়ে না যায় , এই ধরনের মানসিকতা। এবার একটু আসি হিসাবে। যদি প্রতি ক্যান্সার হাসপাতাল পিছু আমরা ৫০০ টি করেও বেড ধরি ( এটা একটি অতিরঞ্জিত সংখ্যা যদিও ) তাহলেও দেখা যাবে ছোট বড়ো হাসপাতাল মিলিয়ে ক্যান্সার এর জন্য বরাদ্দ আছে সর্বসাকুল্যে প্রায় হাজার বিশেক শয্যা। তার মানে ২০০ জন রুগী পিছু ১ টি করে শয্যা বরাদ্দ আছে ( এই ফিগার টা আমি হেল্থ সেবার সাথে জড়িত হবার সুবাদে আনুমানিক ফিগার বললাম)। তার মানে আশা করি বুঝতেই পারছেন যে নামী কিছু হাসপাতালে বেড বা অপারেশনের জন্য শয্যা পেতে কেনো মাসের পর মাস কেটে যায় ?
যেকোনো দেশে ( সে যতো খারাপ ই তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হোক না কেনো ) যদি কোনো ডক্টর কে কোনো ক্যান্সার রুগী বা তার পরিজন জিজ্ঞেস করে যে মাস খানেক দেখে নিয়ে যদি ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট শুরু করা যায় তাহলে কি হবে ? একটাই উত্তর যেকোন যথাযথ ডক্টর মাত্রই দেবেন যা ” সময় নস্ট করা যাবে না, আজকেই ট্রিটমেন্ট শুরু করুন ” তার মানে ডক্টর বা খুব ভালো ভাবেই বোঝেন যে রুগীর ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট এ একদিন দেরি মানেই অনেক দেরি। কিন্তু এই চরম সত্যি কথাটাই আমরা ভারতীয় বা বাংলাদেশীরা মানতে পারি না। আমরা এখনো সিএমসি বা টাটা এর বাইরে ভাবতে পারি না। অথচ এখানে চিকিৎসার বিলম্বের কারণেই যেমন বাড়ছে মৃত্যুহার , তেমনি বাড়ছে খরচ। দুঃখের বিষয় এই ব্যাপারটা বোঝার মতো বুদ্ধিমত্তা বাঙালী দের বিশেষ করে বাংলাদেশী বাঙালিদের একদম ই নেই।
আগামী এক দশকে ক্যান্সার রোগী বাড়বে সুনামির মতো। ভারতে ও বাংলাদেশে ২০২৫ ও ২০৩০ এর মধ্যে ক্যান্সার রোগী বাড়বে যথাক্রমে ২০০ এবং ৩০০ শতাংশ হারে। তার মানে ২০৩০ এ দাড়িয়ে ভারতে ও বাংলাদেশে আনুমানিক বাৎসরিক নতুন ক্যান্সার রুগীর সংখ্যা হবে প্রায় ৩৪ লাখ ও ১০ লাখের কাছাকাছি। এবং যদি যথারীতি এই অনুপাতে হাসপাতাল ও শয্যা না বাড়ে এবং তার সাথে যদি বিশেষ কয়েকটি হাসপাতাল এর উপর ভরসা করার বদ অভ্যাস না পরিবর্তিত হয় তাহলে আগামী দিনে ১ টি শয্যার জন্য লাইন পরবে ৬০০ জনের ও চিকিৎসা পরিষেবা পেতে ৩ মাসের জায়গায় ৬ থেকে ৯ মাস লাগবে। ততদিন একটি ক্যান্সার রুগী বেঁচে থাকবে তো চিকিৎসা না পেয়ে ? ????????
টাটা ব্র্যান্ড টি বোধ হয় ভারতবর্ষের সবথেকে ভরসা যোগ্য ব্র্যান্ড। সৎ ও নিষ্ঠা সহকারে তারা তারা টাটা মেমোরিয়াল এ চিকিৎসা দেন। তারাই দেখলাম একমাত্র হাসপাতাল যারা এখন রুগী কে হাসপাতালে আসতে নিরুৎসাহ করছেন এবং বলছেন তাদের সাথে টেলি কনসালটেশন করে লোকাল ডক্টরের কাছে চিকিৎসা নিতে। যদিও এটি দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো কিন্ত অন্তত হাসপাতালে আগত রুগী কে বিনা চিকিৎসায় রেখে দেবার থেকে তো ভালো। দুঃখের বিষয় আরেকটি বড়ো ও বিখ্যাত হাসপাতাল সি এম সি এটা করছেন না। আমি নাম করেই বলছি, ওখানে ট্রিটমেন্টের দীর্ঘসূত্রতা এতটাই বেশি যে রুগী অপারেশনের ডেট না পেয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করছে অন্ধ বিশ্বাসে আর পরিণামে রোগ আরো ছড়াচ্ছে ও পরিশেষে………
মানুষ টাও বোঝার নয়। কারণ এরা বাঙালী।
আগামী দিনে ক্যান্সার রুগী যদি ক্যান্সার হাসপাতাল দেখে খুঁজে ছড়িয়ে না পড়ে, তাহলে অর্নির্বাজ্য মৃত্যু। তাই জানতে হবে কোথায় কোথায় আছে ক্যান্সার এর বিশিষ্ট হাসপাতাল এবং সেখানে ভরসা করে যেতে হবে কারণ রুগী টি সরকারি নয়, রুগী আপনার নিকটজন।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আশা করা যায় বেশ কয়েকটি বুটিক কান্সার হাসপাতাল উঠে আসবে, যেগুলো আয়তনে বেশি বড়ো হবে না ২০০/৩০০ বেডের হাসপাতাল হবে কিন্তু কেবলমাত্র ক্যান্সার হাসপাতাল ই হবে। আশা রাখি সেই সব হাসপাতাল সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে সমর্থ হবে কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তন করে সেখানে পৌছতে না পারলে আখেরে আমাদের ই ক্ষতি।
তাই আগামী দিনে ক্যান্সার রুগী যদি অতিরিক্ত ভির এর হাসপাতালে লাইন দিয়ে থেকে মারা যায় জানবেন আর কেউ দায়ী নয়। আপনি, কেবলমাত্র আপনার অশিক্ষা আর অজ্ঞানতা নিয়ে আপনি ই দায়ী।
ধন্যবাদ